সুব্রত রায়ের সাহারা গোষ্ঠীর নাটকীয় উত্থান-পতন

সুব্রত রায়ের সাহারা গোষ্ঠীর নাটকীয় উত্থান-পতন

ভারতের সাহারা গোষ্ঠীর কর্ণধার সুব্রত রায়ের উত্থানের কাহিনি কিংবদন্তির মতো শোনালেও বাস্তবতা ঠিক সে রকম নয়। তিলে তিলে এই সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন তিনি। ১৯৭৮ সালে মাত্র ২ হাজার রুপি ঋণ নিয়ে যাত্রা শুরু করেন; এরপরের তিন দশকে তাঁর সাম্রাজ্যের বিকাশ ঘটেছে। অসংখ্য বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে ১০-২০ রুপি করে বিনিয়োগ নিয়ে তিনি হাজার হাজার কোটি রুপির সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। কিন্তু একসময় তাঁর সাহারা নামক সাম্রাজ্যের প্রাসাদগুলো একের পর একে ধসে পড়তে শুরু করে।

সম্প্রতি ৭৫ বছর বয়সে মারা গেছেন ভারতের এই ধনকুবের। মৃত্যুর আগে দীর্ঘ সময় আইনি লড়াই করতে হয়েছে তাঁকে; এর মধ্যেও তিনি সাম্রাজ্যের পরিসর বৃদ্ধি করেছেন। খবর টাইমস অব ইন্ডিয়ার

একবার আদালত তাঁর কাছে প্রমাণ চেয়েছিলেন, তিনি যে কোটি কোটি বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে অর্থ নিয়েছেন এবং মুনাফাসহ সেই অর্থ তাঁদের ফেরত দিয়েছেন, তার প্রমাণ। এর জবাবে তিনি যে কাজ করেছিলেন, তা লোকমুখে বিখ্যাত হয়ে আছে। ১২৮টি ট্রাকে করে ৩১ হাজার কার্টন নথি ভারতের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেবির কাছে পাঠিয়েছিলেন তিনি।

এ ঘটনায় হকচকিত হয়ে যায় সেবি, টন টন কাগজ কীভাবে যাচাই-বাছাই করা সম্ভব? এত পরিমাণ নথিপত্র সংরক্ষণ করাও তো চাট্টিখানি কথা নয়। ফলে সেবি তখন বাধ্য হয়ে এক গুদাম ভাড়া করে। সেই গুদামে নথিপত্র ঘাঁটাঘাঁটির জন্য স্বয়ংক্রিয় রোবোটিক ব্যবস্থা ও ভল্ট ছিল।

এরপর সাহারা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে করা আরেক মামলায় সেবিকে ২০ কোটি পৃষ্ঠা স্ক্যান করা কাগজ ঘাঁটাঘাঁটি করতে হয়েছে। সেই কাজ সহজ করতে এক সার্ভার হোস্টিং ভেন্ডরকে নিয়োগ দিতে হয়, যাতে সহজেই এসব স্ক্যান করা কাগজের হদিস পাওয়া যায়।

সেবির তদন্ত শুরু হয়েছিল মাত্র দুটি অভিযোগের ভিত্তিতে। একটি অভিযোগ করেছিল বিনিয়োগকারীদের ছোট এক গোষ্ঠী। আরেকটি অভিযোগ দায়ের করেছিলেন রোশন লাল নামের এক ব্যক্তি। কিন্তু শেষমেশ এই দুটি অভিযোগই সুব্রত রায়ের নিয়তি নির্ধারণ করে দেয়।

পতনের আগে কী ছিল না সুব্রত রায়ের। আর্থিক প্রতিষ্ঠান, আবাসন ব্যবসা, বিমান চলাচল, লন্ডন ও নিউইয়র্ক শহরে হোটেল, আইপিএলে ক্রিকেট দল, ফর্মুলা ওয়ান রেসিং দল, ভারতের জাতীয় ক্রিকেট ও হকি দলের স্পনসরশিপ, এমন পোর্টফোলিও নিয়ে রীতিমতো উড়ছিলেন সুব্রত রায়।

মহারাষ্ট্রের পাহাড়ি অঞ্চলে আরেকটি উচ্চাভিলাষী আবাসন প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন সুব্রত রায়। ‘আমবি ভ্যালি’ নামের সেই আবাসন প্রকল্পে ভারতের ক্রিকেট থেকে শুরু করে বলিউড তারকা ও রাজনীতিকসহ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির ভিলা নেওয়ার কথা ছিল। তাঁদের সবার সঙ্গেই সুব্রত রায়ের দহরম-মহরম ছিল।

অভিযোগ ছিল, সুব্রত রায় যে লাখ লাখ কোটি রুপি সংগ্রহ করেছিলেন, তা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের নয়, বরং রাজনীতিক, ক্রিকেটার ও বলিউড তারকাদের। যদিও এসব অভিযোগের সপক্ষে প্রমাণ নেই।

সাহারা গোষ্ঠীর আবাসন কোম্পানি সাহারা প্রাইম সিটি লিমিটেডের অন্যতম আবাসন প্রকল্প ছিল এই আমবি ভ্যালি। ২০০৯ সালে শেয়ারবাজারে এই আমবি ভ্যালির আইপিও বা প্রাথমিক গণপ্রস্তাব ছাড়া হলে তখন সেবি তদন্ত শুরু করে।

আইপিওর জন্য জমা দেওয়া খসড়া প্রসপেক্টাস বা প্রস্তাবিকা নিয়ে সেবি তদন্ত শুরু করলে ২০০৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর তাদের কাছে একটি অভিযোগ আসে। প্রফেশনাল গ্রুপ ফর ইনভেস্টর প্রটেকশন সেই অভিযোগে জানায়, তাদের অন্য প্রতিষ্ঠান সাহারা ইন্ডিয়া রিয়েল এস্টেট কো-অপারেশন লিমিটেড অনেক দিন ধরে ভারতে রূপান্তরযোগ্য বন্ড ছাড়ছে, কিন্তু খসড়া প্রসপেক্টাসে তা উল্লেখ করা হয়নি।

এরপর ২০১০ সালের ৪ জানুয়ারি রোশন লাল নামের আরেক ব্যক্তিও একই ধরনের অভিযোগ করেন।  

সেবির আইনজীবী অরবিন্দ দাতার টাইমস অব ইন্ডিয়াকে বলেন, ‘পুরো বিষয়টি শুরু হয়েছে রোশন লালের অভিযোগের মধ্য দিয়ে; তাঁকে আমরা কেউ কখনো দেখিনি; এক শীতের সকালে হিন্দি ভাষায় তিনি সেবিকে চিঠি লেখেন।’

এরপর সেবি সাহারা গোষ্ঠীকে চিঠি পাঠালে তারা এলাহাবাদের হাইকোর্টে স্থগিতাদেশের জন্য আবেদন করে সফল হয়। ৪ জানুয়ারি সেই স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়।

সুব্রত রায়কে কারাগারে পাঠানো হয় ২০১৪ সালের ৪ মার্চ। তখন অরবিন্দ দাতার সেবির জন্য আদালতে দাঁড়ান। আর সেদিনই সাহারা গোষ্ঠীর মূল এফিডেভিটও দেওয়া হয়। মামলা ভারতের সুপ্রিম কোর্টে আসে ৪ জানুয়ারি। এভাবে সেবি-সাহারা কাণ্ডে ৪ তারিখটি (কয়েকটি) উল্লেখযোগ্য হয়ে আছে।  

ভারতের বিভিন্ন আদালতে মামলা চলাকালেও সাহারা গোষ্ঠীর বাণিজ্যিক বিকাশ অব্যাহত ছিল। তখনো তারা কোনো ধরনের অনিয়মের কথা অস্বীকার করছিল। বলেছিল, বিনিয়োগকারীরা মুনাফাসহ অর্থ ফেরত পেয়েছেন।

মামলা যখন এলাহাবাদ হাইকোর্টে ছিল, তখন সাহারা গোষ্ঠীর ২ হাজার কোটি রুপি বিনিয়োগ নিয়ে তদন্ত হয়। সেই মামলা যখন সিকিউরিটিজ আপিল ট্রাইব্যুনালে গেল, তখন সাহারা রিয়েল এস্টেটের অর্থ সংগ্রহের পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার কোটি রুপি। এ ছাড়া সাহারা হাউজিংয়ের সংগ্রহ করেছিল ৬ হাজার ৫০০ কোটি রুপি। তাদের বন্ডে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ৩ কোটি ১০ লাখ ছাড়িয়েছিল। একপর্যায়ে ভারতের সব স্টক এক্সচেঞ্জের বিনিয়োগকারীদের সম্মিলিত সংখ্যাকে তা ছাড়িয়ে যায়।